জামদানি শাড়ি ও জামদানি থ্রি পিস ; বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাপড়

জামদানি শাড়ি ও জামদানি থ্রি পিস হল একটি অনন্য বয়ন পদ্ধতি সহ; কর্পাস তুলা দিয়ে তৈরি একটি পরিধানযোগ্য পোশাক। জামদানী বুনার সময় তৃতীয় একটি সুতা দিয়ে নকশাটি সূচিকর্ম করা হয়। শীতলখ্যা নদীর তীরে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার ;দক্ষিণ রূপশীতে শতাব্দী ধরে উৎপাদিত একটি সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র। জামদানির ইাতহাস থেকে জানা যায়; এই শাড়ি ; উৎপাদন মুঘল সম্রাটদের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব দ্বারা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার অধীনে, ঔপনিবেশিক আমদানি নীতির কারণে শিল্পিকভাবে ; তৈরি বস্ত্রের দ্রুত প্রসারের ফলে বাঙালির জামদানি ;এবং মসলিন শিল্প দ্রুত হ্রাস পায়। সাম্প্রতিক সময়ে জামদানি উৎপাদনে ; বাংলাদেশ নতুন আশার আলো খুজে পেয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশে আবার জামদানি শাড়ি ও উৎপাদনে অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জামদানি সাধারণত সুতি ও সোনার সুতার মিশ্রণে ব্যবহার করা হয়। জামদানি বুননের উপর ভিত্তি করে ;ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে ইউনেস্কো মানবতার অধোরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে ২০১৩ সালে।

প্রসার

সূক্ষ্ম কাপড়ে জামদানি শাড়ির নকশা তৈরির শিল্প ;মুঘল শাসনকালে তার চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। ঢাকা জেলার প্রায় সব গ্রামে তাঁত ছিল। ঢাকা, সোনারগাঁও, ধামরাই, তিতাবাড়ী, জঙ্গলবাড়ি এবং বাজিতপুর উন্নত মানের জামদানি ও মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত স্থান হিসেবে চিহ্নিত ছিল। ইউরোপ, ইরান, আর্মেনিয়া, এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যবসায়ীরা বাংলায় আসতো বাংলার মসলিন কিনতে। মুঘল সম্রাট, বাংলার নবাব এবং অন্যান্য অভিজাতরা রাজপরিবারের জন্য মসলিন ও জামদানি কাপড় সংগ্রহের জন্য ঢাকায় প্রতিনিধিদের নিযুক্ত করতেন।

জামদানি শাড়ি
জামদানি শাড়ি

মুঘল শাসনামলে ঢাকায় মসলিনের স্বর্ণযুগ শুরু হয়েছিল। তখন থেকে দেশে ;এবং বিদেশে জামদানি এবং মসলিন কাপড়ের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। যার ফলে এর কারিগরিতে আরও উন্নতি হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আঠারো শতকের দলিল অনুযায়ী, দেখা যায় সে সময় জামদানি বিদেশে রপ্তনির ; রেকর্ড বজায় রাখে। বাংলার জামদানি অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে; ইউরোপ ও আমেরিকার ঘরবাড়ি এবং ওয়ারড্রোব সাজিয়েছিল।

ব্রিটিশদের আগমন ও জামদানি শাড়ি

তবে এদেশে ব্রিটিশদের আগমনের পর; জামদানির কদর কমতে শুরু করে। কারণ তারা তাদের টেক্সটাইল ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার করতে মরিয়া হয়ে লেগেছিল। তাই কারিগরদের উপর শুরু হয় পাশবিক নির্যাতন। কথিত আছে যে সেই সময়ে কিছু কারিগরের আঙ্গুলও কেটে ফেলা হয়েছিল। ইংরেজদের ক্রোধ থেকে বাঁচতে অনেকেই তাদের পৈতৃক পেশা; ত্যাগ করতে করতে বাধ্য হন। ধীরে ধীরে জামদানি শিল্প ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে; সুতার বাজার অবনতি হতে থাকে। এতে সূক্ষ্ম সুতার চাহিদা কমে যায়। সেটাই ছিল জামদানির ক্ষতির শুরু। যখন ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল; তখন দেশীয় সুতার বাজার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কারণ এটি মেশিনের তৈরি সস্তা বিদেশী সুতার সাথে সামঞ্জস্য; রাখতে পারেনি। বাজারে সুতা নেই, তাই জামদানি উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ। জামদানি শাড়ি তৈরির কারিগররা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলে বাংলার সুপরিচিত জামদানি নকশা হারিয়ে যায়। পরবর্তী ১০০ বছর হল বাংলা থেকে জামদানি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস।

তাঁত
তাঁত

বুনোন কৌশল

মসলিন কাপড় বুননে দক্ষতা সাধারণত সুতা তৈরির শিল্পের উপর নির্ভর করে। সুতা তৈরির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ছিল ভোর বেলা; যেহেতু বাতাস তখন সর্বোচ্চ আর্দ্রতা বহন করে। সুতা তৈরির জন্য তাঁতিদের প্রয়োজন ছিল তাকু, একটি বাঁশের ঝুড়ি, একটি খোসা এবং একটি পাথরের কাপ। তারা স্টার্চের জন্য পপকর্ন, চাল বা বার্লি ব্যবহার করত। জামদানি নকশা তৈরির আগে তারা তাদের সুতা রং করত এবং স্টার্চ করত। রঙের জন্য তারা ফুল এবং লতার পাতা ব্যবহার করেছিল। মানসম্পন্ন জামদানির জন্য তারা ২৫০ থেকে ২৫০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করত। জামদানি তৈরির জন্য দুজন তাঁতি সূক্ষ্ম নকশায় কাজ করার জন্য তাঁতে পাশাপাশি বসেন। জামদানি ডিজাইন তৈরি করা হয় যখন কাপড় এখনও তাঁতে থাকে। মূলত, মোটিফগুলি ধূসর কাপড়ে তৈরি করা হত। পরবর্তীতে অন্যান্য রঙের কাপড়ও ব্যবহার করা হয়। ১৯৬০-এর দশকে, লাল ও নীল কাপড়ের জামদানি কাজ খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে সাদা কাপড়ে সাদা রঙের; কাজ সহ জামদানির চমৎকার সংগ্রহ রয়েছে।

আরো পড়তে পারেন রাজশাহী সিল্ক শাড়ির ইতিহাস

নকশা

জামদানি কাজের বৈচিত্র্য জামদানি কাজের সবচেয়ে বিশেষ; বৈশিষ্ট্য হল এর জ্যামিতিক নকশা। বিশেষজ্ঞ তাঁতীদের কাগজে নকশা আঁকার দরকার নেই। তারা এটা তাদের প্রবৃত্তি থেকে করে থাকে। প্রকৃতির মাঝে বিদ্যমান বিভিন্ন জিনিস নিয়ে তারা শাড়ি বা জামদানি থ্রি পিস বুনে থাকে। ঐতিহ্যবাহী জামদানি নকশাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে অনেকে। কাপড়ে ছোট ছোট ফুলের একটি জামদানি বুটিদার নামে পরিচিত। যদি এই ফুলগুলিকে রিক্লাইন্ড অবস্থায় সাজানো হয় তবে একে টেরসা জামদানি বলা হয়। ময়ূর এবং লতার পাতা দিয়ে নকশা করা থাকে। যদি এই ধরনের নকশাগুলি শাড়ির পুরো ক্ষেত্র জুড়ে থাকে তবে তাকে জলর নকশা বলা হয়। মাঠ যদি সারি সারি ফুলে ঢাকা থাকে তবে এটি ফুলওয়ার জামদানি নামে পরিচিত। দুরিয়া জামদানি সব জায়গায় দাগের নকশা আছে। মোগল আমলে বিশেষ করে হেরেমের মহিলাদের জন্য ;অভ্যন্তরীণ দরবারে রঙিন সোনালি পাড়ের বেলওয়ারি জামদানি তৈরি হত।

জীবনযাত্রা ; জামদানি থ্রি পিস

ঢাকার জামদানি এখনো তার নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে আছে। একটি সাধারণ জামদানি শাড়ি তৈরি করতে; এক থেকে দুই মাস সময় লাগে। যদিও জামদানি অতীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা হত, কিন্তু এটি বুননের মূল গ্রামগুলি ছিল সেই গ্রামগুলি যা এখনও তাদের অতীত গৌরব নিয়ে টিকে আছে। এই গ্রামের তাঁতিরা ঐতিহ্যবাহী জামদানি তাঁতীদের প্রধান বংশধর।

সাইটগুলো হলো

নোয়াপাড়া, দক্ষিণ রূপসী, রূপসী কাজীপাড়া, গন্দবপুর, সিদ্ধিরগঞ্জ, মুগ্রাকুল, খিদিরপুর, ইমকোলি, তারাবো, খালপাড়া, দিঘবোরার, খাদুন, পাবনকুল এবং সুলতানবাগ, তদুপরি, গঙ্গানগর, কাহিনার আশেপাশের গ্রামের কারিগররাও জামদানি তৈরি করে, মীরগোদাই, মহিমপুর, হরিণা নাদির পার এবং মীরকুটির্চিও এবং সোনারগাঁও উপজেলার কিছু এলাকা। বর্তমানে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলায়ও জামদানি উৎপাদিত হয়।

সরকারি উদ্যোগ

বাংলাদেশ সরকার জামদানি শিল্পের বিকাশের জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে; যার মধ্যে একটি জামদানি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট এন্ড রিসার্চ সেন্টার স্থাপন। এর উদ্দেশ্য হল উৎপাদনের মান ও বিপণন সুবিধা বৃদ্ধি করা, জামদানি কারিগরদের অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদান করা, জামদানি উদ্যোক্তা ও তাঁতিদের পুনর্বাসন করা, দক্ষ ও অভিজ্ঞ জামদানি কারিগরদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নীত করা; নকশা সরবরাহ করা এবং জামদানির নমুনা সরবরাহ করা কারিগরদের বাজার; জামদানি পণ্যের গুণগত মান এবং উৎকর্ষতা উন্নত করার গবেষণা পরিচালনা।

পরিশেষে

ইউনেস্কো ২০১৬ সালে জামদানিকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই); পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ঐতিহ্যবাহী নকশা ও বুননের কারণে । আবহমান বাংলার একটি অন্যতম নিদর্শন ;এই জামদানি। এর মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, উপকথা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইত্যাদিকে ফুটিয়ে ওঠার পাশাপাশি; কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে; এ আশা আমরা করতেই পারি।

আমাদের সাথে যুক্ত হতে লাইত দিন নববহ্নি পেজ এ

Check Also

কনস্ট্যান্টিনোপল-জয়

উসমানীয়দের কনস্টান্টিনোপল বিজয়; এক অবিস্মরনীয় যুদ্ধের ইতিকথা

উসমানীয়দের কনস্টান্টিনোপল বিজয়; এক অবিস্মরনীয় যুদ্ধের ইতিকথা। অবিভক্ত রোমান সম্রাজ্যকে একত্রিত করে ; রোমান সম্রাট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *