বাংলা নববর্ষ রচনা;পহেলা বৈশাখ রচনা(বাংলা রচনা)

বাংলা নববর্ষ রচনা

ভূমিকা:

নববর্ষ বিশ্বের প্রায় সব জাতীয়তাবাদী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের একটি অনিবার্য অংশ। বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিরা বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিকে নববর্ষ হিসেবে পালন করে আসছে। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রথা, ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই নববর্ষ। পহেলা বৈশাখ বাঙালির সর্ববৃহৎ সর্বজনীন উৎসব। এই দিনে বাঙালি পুরানো বছরের ব্যর্থতা, হতাশা, ভুলে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় মহা আনন্দে, সমৃদ্ধি ও সুখী জীবনের আশায়।
বাংলা পহেলা বৈশাখ ও বাঙালির চেতনা ও সংষ্কৃতি

বাংলা বর্ষের ইতিহাস:

অধিকাংশ ইতিহাসবিদদের মতে, মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের সূচনাকারী ছিলেন। সিংহাসনে আরোহণের উনিশতম বছরে পদার্পণ করে তিনি; খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বাংলা সন চালু করার তাগিদ অনুভব করেন। সম্রাটের আদেশ অনুসারে তার আমীর ফতুল্লা সিরাজ সূরসান ও হিজরী বছরের সাথে মিল রেখে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। একই সঙ্গে নক্ষত্রের নামের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলার বারো মাসের নামকরণও করেছেন। সেক্ষেত্রে বৈশাখ নামটি এসেছে বিশাখা নামের একটি নক্ষত্রের সাদৃশ্য বহন করে। ইংরেজি ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দ এবং ৯৬৩ হিজরি থেকে বাংলা সাল প্রবর্তিত হয়।

পহেলা বৈশাখ:

আকবরের সময় থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তবে সে সময় এটি ছিল মূলত খাজনা আদায়ের উৎসব। তাই বাঙালির নববর্ষের ধারণা অতি প্রাচীন হলেও ১৯৬৬ সালের আগে নববর্ষ উদযাপনের প্রথা খুব একটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রথম সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। বৈশাখ। পরবর্তীতে আইয়ুবের শাসনামলে নববর্ষ উদযাপনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সর্বোপরি পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর সাংস্কৃতিক নিপীড়ন ও শোষণের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে রমনার গোড়ায় ছায়ানট আয়োজিত নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। বর্তমানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স, শ্রেণী, পেশা নির্বিশেষে পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে।

বাংলা নববর্ষ রচনা
বাংলা নববর্ষ রচনা

বাংলা নববর্ষ রচনা

রাজধানীতে নববর্ষ উদযাপন:

নববর্ষের উৎসব গ্রামবাংলার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও নববর্ষের উৎসবের আবেদন এখন গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ‘এসো সে বৈশাখ, এসো, এসো’ গানের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর রাজধানীর নববর্ষ উৎসব শুরু হয়। উৎসবের প্রধান আয়োজক ছায়ানট পহেলা বৈশাখের সকালে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। রাজধানীর নববর্ষ উদযাপনের একটি অনিবার্য অংশ হল ‘মঙ্গল কুচকাওয়াজ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ সকালে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়। শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ও চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। ১৯৮৯ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউট কর্তৃক আয়োজিত প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রাটি ১৯৯৫ সাল থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে বার্ষিক পালিত হয়ে আসছে। মঙ্গল শোভাযাত্রায়, আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে জীবন্ত করে তোলা হয় বিভিন্ন প্রতীকী শিল্পকর্ম, রঙিন মুখোশ এবং বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপির মাধ্যমে। এছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন যেমন বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ইত্যাদি দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলা নববর্ষ রচনা

রাজধানীর বাইরে নববর্ষ উদযাপন:

গ্রামীণ জীবন ও নববর্ষ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। নতুন বছরে নতুন খাবার ও পিঠাপুলি খাওয়ার উন্মাদনায় রয়েছে গ্রামাঞ্চল ও গ্রামের মানুষ। সাধ্যমতো নতুন জামাকাপড় পরে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী সবাই একে অপরের সঙ্গে দেখা করে অবর্ণনীয় আনন্দ। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও যোগ হয়েছে নতুন গতি। ঢাকার বাইরে অন্যান্য শহরেও স্থানীয়রা ধুমধাম করে নববর্ষ উদযাপন করে। এতে বিভিন্ন মেলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।

বাংলা নববর্ষ রচনা

নববর্ষ ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী:

বাঙালি ছাড়াও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরাও বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করে। তিন পার্বত্য জেলায় (বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি) অঞ্চলে নববর্ষ উদযাপন অনেকটাই বৈশাবীকে কেন্দ্র করে। চাকমারা নববর্ষের উৎসবকে ‘বিজু’, মারমারারা ‘সাংগ্রাই’ এবং ত্রিপুরারা একে বৈসুক বলে। এই তিনটি উৎসবের মিলিত নাম বৈসাবি। সংখ্যালঘুরা তাদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবগুলো আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপন করে।

আরো পড়ুনবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচনা;বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ রচনা
স্বাধীনতা দিবস রচনা-Independence Day Essay(বাংলা রচনা)

নববর্ষে বাঙালি:

জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ নববর্ষ উদযাপনে অংশগ্রহণ করে। এই দিনে বাঙালি মেয়েরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ি পরে এবং পুরুষরা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে। প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে বিশেষ খাবার বিশেষ করে পান্তা-ইলিশ, বিভিন্ন ধরনের পিঠাপুলি। সর্বোপরি সকল স্তরের বাঙালিরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন বছরের প্রথম দিনটি উদযাপন করে।

বৈশাখী মেলা:

বাংলা নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণ বৈশাখী মেলা। শহরের চেয়ে গ্রামে মেলা বেশি হয়। এই মেলার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এটি কোন ধর্মীয় ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে নয় বরং এটি বাঙালির সবচেয়ে বড় সার্বজনীন উৎসব। মেলায় বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য ও প্রথার কথা উঠে আসে। মেলার প্রধান আকর্ষণ প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন সংস্কৃতি যেমন যাত্রা, পুতুল নাচ, সার্কাস, বায়োস্কোপ, নাগরদোলা ইত্যাদি। বৈশাখী মেলায় বিভিন্ন কুটির শিল্প, মাটির পাত্র, বাসন, পুতুল, বেত ও বাঁশের বাসন, খেলনা, তালপাতা ইত্যাদি। ফ্যান ইত্যাদি পাওয়া যায়। এছাড়া বৈশাখী মেলায় চিরন, মুড়ি, খই, বাতাসাসহ নানা ধরনের মিষ্টান্ন রয়েছে। বর্তমানে এই মেলা সবচেয়ে বড় লোকমেলায় পরিণত হয়েছে। এটি মূলত গ্রামীণ জীবনের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি।

হালখাতা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান :

হালখাতা মূলত ব্যবসায়ীদের পুরনো বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলার উৎসব। আকবরের সময় থেকেই এর প্রচলন রয়েছে। তখন চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করতে হতো এবং পহেলা বৈশাখে জমির মালিকরা নিজ নিজ এলাকার মানুষকে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। একে হালখাতা বলে। বর্তমানে ব্যবসায়ীরা পুরাতন বই বন্ধ করে নতুন বছরের দিন খুলে দেন। পুরান ঢাকায় ‘হালখাতা’ উৎসব বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়। গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, কুস্তি ও গম্ভীরা, লোকগানের আঞ্চলিক অনুষ্ঠান ও নৃত্য। বাংলাদেশে কুস্তির সবচেয়ে বড় আসর হয় মূলত চট্টগ্রামে।

বাংলা নববর্ষ রচনা
বাংলা নববর্ষ রচনা

নববর্ষের প্রভাব:

প্রাচীন বাঙালি ঐতিহ্যের ভিত্তি মজবুত করতে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ ফিরে আসে। সারা বছরের হিংসা বিদ্বেষ ভুলে মানুষ এই দিনে উৎসবে মেতে ওঠে। বিশেষ করে নগরজীবনে এর প্রভাব অনেক বেশি। কারণ, নাগরিক জীবনের চাপে নগরবাসী সারা বছরই বাঙালি আদর্শকে প্রায় ভুলে যায়। নগরবাসীর মনে বাঙালির ছোঁয়া নিয়ে আসে বাংলা নববর্ষ। নববর্ষে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি হয়ে ওঠে উজ্জীবিত। নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে সচেতন হয়।

বাংলা নববর্ষ রচনা

নববর্ষের তাৎপর্য:

নববর্ষ আমাদের জাতীয় উৎসব। পহেলা বৈশাখ অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা দেয় আমাদের জাতীয় চেতনা ও একচেটিয়া বাঙালি সত্তা। এই দিনে আমরা এই অনুভূতি পার করতে পারি, কোনো বিশেষ ধর্ম বা বর্ণ নয়, শুধুমাত্র একটি বাঙালি সত্তা। এই দিনটিকে সামনে রেখে শিশুরা জানতে পারে বাঙালির ইতিহাস। নতুন বছর আমাদের নতুন জীবন দেয়। সর্বোপরি নববর্ষের অনুপ্রেরণায় আমাদের মধ্যে সুপ্ত মানবিক মূল্যবোধ নতুন করে জাগ্রত হয়, মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে সম্প্রীতি।

দিন বদলের পালায় নববর্ষ:

মানব সভ্যতার অগ্রগতি ও বিকাশের পথ ধরে সবকিছুতেই রয়েছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এর মধ্যে কিছু ইতিবাচক আবার কিছু নেতিবাচক। বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। বাঙালিরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও রীতিনীতির মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালন করে। কিন্তু বর্তমানে বিদেশী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবকে কলুষিত করছে। নাচ-গান, মেলা ও বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার স্থান দখল করে নিচ্ছে বিদেশি সংস্কৃতি। নববর্ষ উদযাপনের প্রকৃত স্বাদ ও তৃপ্তি থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। উৎসবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বাণিজ্যিকীকরণ ও বাড়াবাড়ি উৎসবের মূল আনন্দকে কলঙ্কিত করছে। মানুষ তার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ছে। অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে নতুন বছরের মধ্যে কিছু অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটেছে; যা বাঙালি জাতি ও নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
বাংলা নববর্ষ রচনা

উপসংহার:

নববর্ষ আমাদের জীবনে শুধু একটি উৎসব নয়, এটি চেতনার প্রতীক। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে নতুন বছর আমাদের উদ্বুদ্ধ করে মানবতাবোধে। এই দিনটি আমাদের অনুপ্রাণিত করে দরিদ্র, নিপীড়িত, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। নববর্ষ একদিকে নির্মল আনন্দের খোরাক, অন্যদিকে চেতনার বাহক। আর তাই প্রতিটি বাঙালিকে সচেতন হতে হবে যেন কোনো সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস আমাদের ঐতিহ্যকে গ্রাস করতে না পারে।

আমোদের সাথে যুক্ত হতে লাইক দিন নববহ্নি পেজ এ

Check Also

স্বাধীনতা দিবস রচনা

স্বাধীনতা দিবস রচনা- (২৬শে মার্চ ) Independence Day Essay (26 March) (বাংলা রচনা)

স্বাধীনতা দিবস রচনা independence day paragraph ভূমিকা: স্বাধীনতা মানে স্বাধীন বা স্বাধীন হওয়ার অবস্থা। স্বাধীনতা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *