হাসান সাব্বাহ- গুপ্তঘাতকের সূচনা যার হাতে

গুপ্তঘাতক বা অ্যাসাসিন হল এক দল যোদ্ধা; যারা নিজেদের পরিচয় গোপন করে বিভিন্ন এলাকায় হত্যাকান্ড চালায়। হলিউডের অনেক মুভিতে এমন দৃশ্য আমরা সচরাচর দেখা যায়। তবে অতীতে এমন একদল লোক ছিল যারা এই কাজ সংগঠিত করত। মূলত তাদের হাত ধরেই এই গুপ্তঘাতকদের সূচনা। মিশরের অদূরে সমরখন্দ নামক স্থানে হাসান সাব্বাহ নামক ;এক ব্যক্তির হাত ধরে এই গুপ্তঘাতক বা অ্যাসাসিনদের সূচনা ঘটে।

হাসান সাব্বাহ পারস্যের কোম শহরে ১০৫০ সালে ;এক শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তার পরিবার “রে” তে স্থানান্তিরিত হয়। “রে” শহর ছিল ইরানের ইসমাইলী ধর্মমত প্রচারের অন্যতম কেন্দ্র। হাসান সাব্বাহ তার প্রাথমিক শিক্ষা এখানেই লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ইসমাইলী মতবাদের শিক্ষা নেন ও ;রে শহরের প্রধান ইসমাইলী মতবাদ ;প্রচারকারীর নিকট আরো শিক্ষা লাভ করেন।

এর ফলে তিনি সতের বছর বয়সে ইসমাইলী মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে; তৎকালীন ইসমাইলী ইমাম আল-মুনতাসির এর আনুগত্যের শপথ করেন। আল মুনতাছির ছিলেন সে সময়ের ফাতিমিয় খলিফা। তিনি তার জ্ঞান ও কাজের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন ;ও খলিফার তাকে কাজে নিযুক্ত করেন । তাকে খলিফার দরবারে তাকে নিয়মিত উপস্থিত হতে বলা হয়।

হাসান সাব্বাহ
হাসান সাব্বাহ

এরপর

তিনি আর খলিফার দরবারে না গিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকেন। পরে মিশরের খলিফার কাছে উপস্থিত হন। সেখানে প্রচারিত দাওয়াতি কাজ তাকে পরিচিত করে তোলে। এবার তিনি পারস্য, খোরাসানে ইসমাইলি মতবাদ প্রচার করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে তিনি খলিফার বড় ছেলে নেযার এর অনুসারে দাওয়ত প্রচার করতে থাকেন। নিজেকে মনে করেন সহযোগী। কিন্ত খলিফা মুনতাসির মারা গেলে বড় ছেলের পরিবর্তে ছোট ছেলে আল মুসতালি বিল্লাকে খলিফা বানানো হয় ও তার হাতে সবাই বায়াত গ্রহণ করে। এসবের ফলে বড় ছেলের অনুসারীরা নেযারি দলের গোড়াপত্তন করে। এই থেকেই ইসমাইলিদের মধ্যে দুইটি ভাগ হয়ে যায়।আর এসবের মূলে ছিলেন হাসান সাব্বাহ। আর নেযারি দাওয়াদের থেকেই বাতিনি ;ও হাসাসিনদের তৈরি হয়।

এরপর হাসান তার অনুসারীদের নিয়ে ;তার বাতিনী ধর্মমত প্রচার করতে থাকেন। তার প্রধান টার্গেট হয় ইরান ও কাস্পিয়ান অঞ্চলের দিকে। তার অনুসারীদের অন্য অঞ্চলে পাঠান। নিজাম-উল-মুলুকের কানে গেলে তিনি তাকে বন্দি করতে সেনাবাহিনী পাঠান। হাসান তাদের কৌশলে ফাকি দিয়ে গভীর পাহাড়ি অঞ্চলে প্রবেশ করেন। নিসন্দেহে হাসান ছিলেন প্রখর বুদ্ধিমান ;ও ধূর্ত মেধার অধিকারী।

তারপর তিনি তার কাজের প্রসারের জন্য একটি নির্জন জায়গা খুজতে থাকেন। ১০৮৮ সালে তিনি আলমুট শহরের দেখা পান। সেখানেই তিনি তার ধর্ম প্রচার করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। আলামুটে একটি দূর্গ ছিল যা প্রায় ৫০ মিটার লম্বা ও ৫ কিমি চওড়া। কথিত আছে এখানে এক রাজা ঈগল শিকার করার সময় এক ইগলকে উড়ে গিয়ে পাহাড়ের উপর বসতে দেখেন ও ;এটিকে শুভ লক্ষণ হিসেবে নেন। তিনি সেখানেই এই দূর্গ নির্মাণ করেন। এইজন্যই এর নামকরণ করা হয় আলামুট বা ঈগলের বাসা।

আরো পড়তে পারেন মুহাম্মদ আলীঃ দ্য পিপলস চ্যাম্পিয়ন

দূর্গ দখল করার পর তিনি তার কাজ শুরু করেন। তৈরি করেন গুপ্তঘাতকের সংগঠন। গুপ্ত হত্যা ও যুদ্ধের মাধ্যেমে তিনি তার পরিচিতি জানান দেন। তিনি তরুণ যুবকদের সংগ্রহ করতেন ও তাদের মাধ্যমে এই কাজ সম্পন্ন করতেন।

আলামুট দুর্গে তিনি বেহেস্তের আদলে এক বেহেস্ত তৈরি করেন। পাহাড়ের উপর দেওয়াল ঘেরা বিচিত্র গাছপালা, ঝর্ণা, রেশমী কাপড়ের তাবু। কিয়স্কওয়ালা আনিন্দ্য সুন্দর উদ্যান ও চোখের আরালে থাকা বাদকদের মোহিনীয় বাদ্য তাদেরকে আক্ষরিক অর্থে বেহেস্ত হিসেবে ধরা দিত। তাদের খেদমতে ছিল সুন্দর সুন্দর নারী। হাশিশ নামক এক মাদক দিয়ে আচ্ছন্ন করে তাদের হাসানের বেহেস্তে প্রবেশ করাতো। মাদকের নেশা কাটলে তাদের অন্ধ কুপে বন্দি করা হত। তাদের বলা হয় তারা যদি বেহেস্তে যেতে চায় তবে তাকে হাসানের আদেশ মানতে হবে। বেহেস্তে যাওয়ার ইচ্ছা তাদের মৃত্যু ভয় কমিয়ে দিতো। এর ফলে হাসান তাদের দিয়ে বিভিন্ন ;গুপ হত্যা অনাআসেই ঘটাতে পারতেন। নিজাম-উল-মুলক সহ অনেক ব্যাক্তি তাদের শিকার হয়।

ঐতিহাসিক এবং পণ্ডিতরা হাসান সাব্বাহকে নিজারি হত্যাকারী ;এবং তাদের মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বণর্ণা করেছেন। কায়রোর ফাতিমী সিংহাসনে নিজারের উত্তরাধিকার সংগ্রামের সময় ;এটি বিকশিত হয়েছিল যা অবশেষে নিজারি ইসমাইলিজম; শিয়া ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

তখন থেকেই তাদের বিশ্বাস করানো হতো যে, রক্ষণশীল প্রকৃতির একটি মৌলিক উপাদান হিসাবে ইসমাইলি ইমামতে দৃশ্যমান ;ও সেই সময়ের ইমাম ছাড়াও একটি লুকানো ইমাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়াও হাসান ছাব্বাহ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল শিক্ষার প্রসার ;এবং অপ্রকাশিত ইমামের আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা, প্রদান করা। একজন নিজারী হত্যাকারীকে ফিদাই বা ভক্ত হিসেবে তখনই চিহ্নিত করা হয় ;যখন সে কোন বিশেষ কারণে সেবার জন্য নিজের জীবন প্রদান করে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, তিনি এতটাই নিষ্ঠাবান ছিলেন যে ;এমনকি তার এক পুত্রকেও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন মাতাল হওয়ার অভিযোগে।

পরবর্তী সময়ে তাকে আর দূর্গের বাইরে দেখা যায়নি। ১১২৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে হাসান মারা গেলেও; তার কার্যক্রম চলতে থাকে। পরবর্তীতে মঙ্গোলরা ১২৫৬ সালে তার দূর্গ ধ্বংস করে।

এভাবেই তৈরি হয় ইতিহাসে প্রথম ত্রাস সৃষ্টিকারী এই সংগঠন।

আমাদের ফলো করতে পারেন নববহ্নি পেজ এ

Check Also

চেঙ্গিস খান

চেঙ্গিস খান ও মঙ্গোলদের উত্থান

চেঙ্গিস খান মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং; যা তিনি ১২০৬ সাল থেকে ১২২৭ সাল পর্যন্ত …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *