উসমানীয়দের কনস্টান্টিনোপল বিজয়; এক অবিস্মরনীয় যুদ্ধের ইতিকথা

উসমানীয়দের কনস্টান্টিনোপল বিজয়; এক অবিস্মরনীয় যুদ্ধের ইতিকথা। অবিভক্ত রোমান সম্রাজ্যকে একত্রিত করে ; রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টাইন ৩৩০ থ্রিস্টাব্দ থেকে কনস্টান্টিনোপলকে বাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে অনেক অক্রমণ হলেও ;ক্রসেডার ও নাইসিয়ানরা ছাড়া কেউ কনস্টান্টিনোপল দখল করতে পারে নি। একের পর এক আক্রমণ ও মহামারীর কারণে; অঞ্চলটির আধিপত্য খর্ব হতে থাকে। সর্বশেষ অটোমানদের আক্রমণে প্রায় ১৫০০ বছরের মত টিকে থাকা রোমান সম্রাজ্যের তথা; কনস্টান্টিনোপল এর স্থায়ী পতন ঘটে।

ভৌগলিক অবস্থান

ভৌগলিক অবস্থানের কারণে কনস্টান্টিনোপল ছিল ;সে সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী নগরী। তিন দিকে জল ভাগ ও সামনের অংশে ছিল দুর্ভেদ্য দেওয়াল। অনেকটা ত্রিভুজাকৃতি শহরটি গোল্ডেন হর্ণ ; বসফরাস প্রণালী ও মার্মার সাগর। ফলে অনেকটা প্রাকৃতিক ভাবে সুরক্ষিত ছিল এ নগরী। চারপাশের দেওয়ালগুলো ছিল; ৪০ ফুট উঁচু ও ৬০ ফুট পুরু। কিছু দুর পরপর ছিল ওয়াচ টাওয়ার ;যা দিয়ে গরম পানি ঢেলে দেওয়া যেত।

আরো

ছিল গ্রিক ফায়ার নামে এক ভয়ংকর অস্ত্র; যার আগুন পানি দিয়েও নেভানো যেত না। নৌ আক্রমণ ঠেকানোর জন্য ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। গোল্ডেন হর্ণ থেকে বসফরাস পর্যন্ত বিশাল আকার চেইন যা দিয়ে নৌ জানের তলা ফাটিয়ে দেওয়া যেত।এত সুরক্ষার পরেও পতন হয়েছিল কনস্টান্টিনোপলের । কারণ পৃথিবীর কোন কিছুই স্থায়ী নয়। হাজার বছরের ;এই সম্রাজ্যের পতন হয়েছিল সুলতান মুহাম্মদের হাতে।

আল-ফাতির জন্ম

সুলতান মুহাম্মদ ১৪৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৭ম উসমানীয় সুলতান ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন দুরন্তপনা ও একঘেয়েমি। যা সুলতান মুরাদকে( তার বাবা) ভাবিয়ে তোলে। কারণ দুই সন্তানের মৃত্যুর পর মুহাম্মদ ছিলেন পরবর্তী উত্তরসূরী। তাই যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কয়েকজন শিক্ষক নিয়োগ করেন। অল্প বয়সেই ইসলামিক শিক্ষা তার জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কনস্টান্টিনোপল জয় করার ক্ষেত্রে আকশামসউদ্দিন তরুণ বয়সে তার উপর প্রভাব ফেলেছিলেন।

উসমানীয়দের কনস্টান্টিনোপল বিজয়

বাল্য জীবন

১৪৪৪ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে সুলতান হন,যখন তার বাবা সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ মসনদ ত্যাগ করেন। তরুণ সুলতান দেখে বিদ্রোহীরা চুক্তি ভঙ্গ শুরু করে। তার পক্ষে সে সময় এ বিদ্রোহ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাই মুহাম্মদ পিতা মুরাদকে পুনরায় মসনদে বসার অনুরোধ করেন। মুরাদ তাতে অসম্মতি দিলে তিনি কঠোর ভাবে বাবাকে চিঠি লেখেন- তাতে বলা ছিল ; যদি আপনি সুলতান হন তবে এগিয়ে এসে সেনাদের নেতৃত্ব দিন। যদি আমি সুলতান হই তবে আমি নির্দেশ দিচ্ছি; আপনি আমার সেনাদের নেতৃত্ব দিন। এরপর মুরাদ দায়িত্ব গ্রহণ করেন ও ১৪৪৪ সালে ভারনার যুদ্ধে জয়লাভ করেন।

উসমানীয়দের কনস্টান্টিনোপল বিজয়

সুলতানের দ্বায়িত্ব গ্রহণ

১৪৫১ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ তার পিতার উত্তরাধিকারী হন। তারা ধারণা করতেন ১৯ বছর বয়সী সুলতান তাদের জন্য কোন হুমকি হবে না । তবে তার কাজ তার কথার চাইতেও বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৪৫২ সালের দিকে তিনি বসফেরাসে ;রুমেলি হিসারি নামক দ্বিতীয় উসমানীয় দূর্গ গড়ে তোলেন। একই সাথে তিনি রাজ্য বিস্তারে মন দেন ও; তার মাথায় কনস্টান্টিনোপল জয় করার চিন্তা ঘুরতে থাকে।

সুলতান

মুহাম্মদ যে সময় দ্বায়িত্ব নেন সে সময় ইউরোপের অবস্থা ছিল নড়বড়ে। তারা একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। সুলতান এই সুযোগ টাই নিতে চাইলেন। কনস্টান্টিনোপল অক্রমণ করলে তারা সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারবে না। প্রধান উজির হালিল পাশার অনিচ্ছা সত্বেও তিনি মনস্থির করলেন কনস্টান্টিনোপল আক্রমণ করবেন। কনস্টান্টিনোপল আক্রমণের থবর সালতানাতে ছড়িয়ে পড়ল। অনেকে স্বেচ্ছায় যোগ দিতে লাগলেন। কারণ সে সময় মহানবী (সঃ) এর একটি হাদিস প্রচলিত ছিল। মহানবী (সঃ) বলেছিলেন-

মুসলিমরা একদা কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে। তাদের সেই বিজয়ী সেনাপতি কতই না সৌভাগ্যবান। সেই বিজয়ী সেনাদল কতই না বরকতময়।

আরো পড়তে পারেন উসমানীয় সম্রাজ্রের উত্থান

উসমানীয়দের কনস্টান্টিনোপল বিজয়
উসমানীয়দের কনস্টান্টিনোপল বিজয়

যুদ্ধের প্রস্তুতি

এই ভবিষ্যদ্বাণীটির প্রতি মুসলমানদের এতই বিশ্বাস ছিল যে; সবাই এ যুদ্ধে অংশ নিতে চাইল। ফলে যুদ্ধের ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হল। এসময় সুলতান আরেক চমকের দেথা পেলেন। হাঙ্গেরির দক্ষ প্রকৌশলী তার কাছে বিশেষ এক কামানের নকশা নিয়ে আসেন যা সুলতানের পছন্দ হয় কারণ তিনিও ছিলেন কামান নকশাকার। সুলতান তার সকল দাবি মেনে নেন এবং তৈরী করান বিথ্যাত কামান ব্যালিসিকা। এ কামান এতই বড় ছিল যে তা বহন করতে ৩০ জোড় ষাঁড় ও ৩০০ সৈনিকের। এ কামানের সীমাবদ্ধতা হলো; তিন ঘন্টা পর পর কামান থেকে গোলা ছোড়া যেত, তবুও এটি ছিল যুদ্ধে মোড় ঘুরিয়ে দেবার মত অস্ত্র।

উসমানীয়দের কনস্টান্টিনোপল বিজয়

বাইজেন্টাইনরাও

যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলো । মাত্র আট হাজার সৈন্য হলেও; তারা আত্নবিশ্বাস ছিল গোল্ডেন হর্ণের চেইন এবং উচু ও পুরু দেওয়াল। তারা চিন্তা করেছিলো অটোমানরা কখনোই তা ভাঙ্গতে পারবে না। ১৪৫৩ সালের এপ্রিল মাসে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। শহরের অদূরে তাবু স্থাপন করলেন সুলতান মুহাম্মদ। যুদ্ধ শুরুর আগে বাইজেন্টাইনদের আত্নসমর্পণের ;প্রস্থাব দিয়ে চিঠি পাঠানো হলো। তারা আত্নসমর্পণে অস্বীকৃতি জানালে যুদ্ধই হয় তাদের মধ্যকার শেষ পরিণতি।

যুদ্ধ

শুরু হল প্রচন্ড যুদ্ধ। ব্যাসিলিকা কামান গর্জে উঠল। বিশালাকার গোলা থিওডেসিয়ান দেয়াল কাপিয়ে দিতে লাগলো; কিন্তু কিছুই করা যাচ্ছিলো না। কারণ তিন ঘন্টার ব্যবধানে তারা দেওয়াল মেরামত করে নিচ্ছিলো। যুদ্ধের একদিন ব্যাসিলিকা কামান দেওয়ালের একটি অংশে গর্ত করতে সক্ষম হয়। অটোমান সৈন্যরা ওই দিক দিয়ে প্রবেশ করতে চাইলে ;তাদের উপর আসে গ্রিক ফায়ারের ফাঁদ। ফলে ভিতরে আর প্রবেশ করা সম্ভব হয় নি। অন্যদিকে নৌ জাহাজগুলো গোল্ডেন হর্ণ পার হতে পারছিলো না।

এরপর

সুলতান এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেন। জাহাজগুলো যেহেতু গোল্ডেন হর্ণ পার হতে পারছিলো না;তাই নির্দেশ দেওয়া হল জাহাজগুলোকে বালির উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার। গাছের গুড়ির উপর মোষের চর্বির প্রলেপ দিয়ে রাতের আধারে টেনে নেওয়া হল জাহাজ। এক রাতের ভিতরেই ৭০ টি জাহাজ গোল্ডন হর্ণে প্রবেশ করলে যুদ্ধের মোড় বদলে যায়। তবুও তেমন কোন সফলতার মুখ দেখতে পারে নি উসমানীয়রা।

এবার নতুন এক পরিকল্পনা হাতে নিল অটোমানরা। সুরঙ্গ খুড়ে শহরে প্রবেশ করা হবে। দুর্ভাগ্যবসত বাইজেন্টাইনরা জেনে যায় এই পরিকল্পনা। বাইজেন্টাইনরা পাল্টা সুরঙ্গ খুঁড়ে গ্রিক ফায়ার দিয়ে আক্রমন করে অটোমানদের । ফলে এ পরিকলপনাও ভেস্তে যায়। সুলতান নিজেও হতাশ হয়ে পড়েন। সৈন্যবাহিনীর মোনবল ও ভেঙ্গে পড়ে।
উসমানীয়দের

এবার সুলতানের সাথে দেখা করতে আসেন আকা শামসুদ্দিন ; ও আহমদ কুরআনি। তাদের কথায় সাহস ফিরে পান সুলতান। তার জাদুকরী বক্তব্যে সৈন্যরা উজ্জীবিত হয়ে নতুন উদ্যমে নেমে পড়ে। ভোরের আলো ফুটতেই ব্যাসিলিকা কামান গর্জে উঠল। একের পর এক গোলার আঘাতে অবশেষে দেয়ালে গর্ত তৈরী হয়। শত শত সৈন্য ঢুকতে থাকে সেখান দিয়ে।
উসমানীয়দের কনস্টান্টিনোপল বিজয়

বিজয়

শুরু হল প্রচন্ড যুদ্ধ। বাইজেন্টাইনরাও লড়ে যাচ্ছে প্রাণপণে। এরই মাঝে হাসান উলুবাদি নামে এক সিপাহী মই নিয়ে উঠে যান দেওয়ালের উপর। একের পর এক তীর এসে লাগলো তার শরীরে। তবুও দমে যান নি। সব বাধা অতিক্রম করে হাসান বাইজেন্টাইন পতাকা ছুড়ে ফেলে দিয়ে সেখানে অটোমান পতাকা স্থাপন করেন। দূর্গের উপর নিজেদের পতাকা দেথে মনোবল বেড়ে যায় সেনাদের। বেশিক্ষণ আর টিকতে পারেনি তারা। বাইজেন্টাইন সম্রাট নিজেও যুদ্ধ করে গেছেন আমৃত্যু। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সেনারা শহরে প্রবেশ করে। ফলে ১৫০০ বছরের বাইজেন্টাইন সম্রাজ্য অটোমানদের হাতে আসে। একই সাখে ইউরোপে প্রবেশের দ্বার খুলে যায়।

সুলতান মুহাম্মদ বিজয়ী বেশে প্রবেশ করেন। কনস্টান্টিনোপলের নাম রাখেন ইস্তাম্বুল। সুলতানের নামের শেষে যুক্ত হলো ফাতিহ অর্থাৎ বিজয়ী।
উসমানীয়দের কনস্টান্টিনোপল বিজয়
আমাদের সাথে যুক্ত হতে লাইত দিন নববহ্নি

Check Also

পহেলা বৈশাখ

বাংলা পহেলা বৈশাখ ও বাঙালির চেতনা ও সংষ্কৃতি

বাংলা পহেলা বৈশাখ লোক সমাজের সাথে নাগরিক জীবনের সেতুবন্ধন পহেলা বৈশাখ। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে জীবনে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *